ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানীর পূর্বাচলে রাজউকের নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে তিনটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিটিতে সাত বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদ- দিয়েছেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক। এর মধ্যে একটি মামলায় শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ৫ বছরের কারাদ- ও ১ লাখ টাকা অর্থদ- এবং অন্য একটি মামলায় মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ৫ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে তিন মামলায় ৬ বছর করে ১৮ বছরের কারাদ- দিয়েছেন বিচারক।
ঢাকার ৫ম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন গতকাল বৃহস্পতিবার এ রায় ঘোষণা করেন। এ সময় আদালত তার পর্যবেক্ষণে সরকারি প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে ‘বিশেষ সুপারিশের বিধান’ অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই রায়ের ফলে পূর্বাচল নিউ টাউন প্রকল্পের ৯ নম্বর প্লটটির বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্লটটির দখল নিয়ে যোগ্য আবেদনকারীকে আইনানুসারে বরাদ্দ দিতে রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিন মামলায় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ছাড়াও অন্য ২০ আসামি হলেন সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) শফি-উল-হক, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মেজর (ইঞ্জি.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, রাজউকের সাবেক উপ-পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরীফ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদ, সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নুরুল ইসলাম, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলাম, পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মো. কামরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান, উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব মোহাম্মাদ সালাউদ্দিন।
আসামিদের মধ্যে একমাত্র মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গ্রেপ্তার আছেন। একই আদালত প্লট বরাদ্দে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে গত ২৩ নভেম্বর শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে করা তিন মামলার রায়ের জন্য ২৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। পৃথক তিনটি মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৪৭ জন। তবে এক ব্যক্তি একাধিক মামলার আসামি হওয়ায় ব্যক্তি হিসেবে মোট আসামির সংখ্যা ২৩ জন। এর মধ্যে প্রথম মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ১২ জন; দ্বিতীয় মামলায় শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়সহ আসামি ১৭ জন এবং তৃতীয় মামলায় শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আসামি ১৯ জন।
বিচার কাজ চলাকালে ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। গত ১৭ নভেম্বর পৃথক তিন মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক ৬টি মামলা করে। এসব মামলায় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ অন্যদের আসামি করা হয়। সেই ৬ মামলার মধ্যে বৃহস্পতিবার তিনটির রায় দিলেন আদালত।
গত ৩১ জুলাই আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালত তিনটি মামলাতেই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
প্লট বরাদ্দে বিশেষ সুপারিশের বিধান বন্ধের নির্দেশ ॥ রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলার রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অর্থদ- ও কারাদ- দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে ‘বিশেষ সুপারিশের বিধান’ অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এই রায়ের ফলে পূর্বাচল নিউ টাউন প্রকল্পের ৯ নম্বর প্লটটির বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্লটটির দখল নিয়ে যোগ্য আবেদনকারীকে আইনানুসারে বরাদ্দ দিতে রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালত এই রায়ের পাশাপাশি রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পর্যবেক্ষণ জারি করে বলেছেন যে, তারা ধারাবাহিকভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারসহ অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিকে সুবিধা দিয়েছে, যা ‘এলিট ক্যাপচার’ বা অভিজাতদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের প্রমাণ।
এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ করতে আদালত রাজউককে অবিলম্বে অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করে সব বরাদ্দের ফরেনসিক অডিট করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি কমাতে ডিজিটাল লটারি সিস্টেম চালু করার কথাও বলেছেন আদালত।
২২ জনের কে কোন সাজা পেলেন ॥ ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির মাধ্যমে রাজধানীর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সরকারি জমি বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে করা মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদ- ও অর্থদ-ের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি বিশেষ আদালত। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা তিন মামলায় অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাকে সাত বছর করে মোট ২১ বছরের সশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি মামলায় এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদ- করেন আদালত। অর্থদ- অনাদায়ে আরও ১৮ মাসের কারাভোগ করতে হবে তাকে।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এক মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- ও এক লাখ টাকা অর্থদ- পেয়েছেন। অর্থদ- অনাদায়ে তাকে ছয় মাসের অতিরিক্ত কারাভোগ করতে হবে। একইভাবে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও এক মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- ও এক লাখ টাকা জরিমানার দ-ে দ-িত হয়েছেন। অর্থদ- অনাদায়ে তিনি ছয় মাস অতিরিক্ত সাজা পাবেন।
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে পৃথক দুই মামলায় ছয় বছর করে মোট ১২ বছরের কারাদ- ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ তিন মামলায় ছয় বছর করে ১৮ বছরের কারাদ- ও তিন লাখ টাকা অর্থদ-ে দ-িত হয়েছেন। একই মেয়াদে এবং সমপরিমাণ জরিমানা করা হয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনকেও।
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পুরবী গোলদার তিন মামলায় এক বছর করে তিন বছরের কারাদ- ও ২০ হাজার টাকা অর্থদ-ে দ-িত হয়েছেন। রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞাকে তিন মামলায় পাঁচ বছর করে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদ- ও দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত। রাজউকের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী তিন মামলায় তিন বছর করে নয় বছরের কারাদ- ও জরিমানায় দ-িত হয়েছেন।
রাজউকের সাবেক সদস্য কবির আল আসাদ এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদ- ও ২০ হাজার টাকা জরিমানার দ- পেয়েছেন। সাবেক সদস্য তন্ময় দাস এবং মো. নুরুল ইসলাম পৃথক দুই মামলায় তিন বছর করে ছয় বছরের কারাদ-ে দ-িত হয়েছেন। রাজউকের সাবেক পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক কামরুল ইসলাম উভয়ই এক মামলায় তিন বছরের কারাদ- পেয়েছেন।
রাজউকের সাবেক উপ-পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান এবং হাবিবুর রহমানও এক মামলায় এক বছর করে কারাদ- ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানায় দ-িত হয়েছেন। একই পদমর্যাদার নায়েব আলী শরীফ দুই মামলায় এক বছর করে দুই বছরের কারাদ-ে দ-িত হয়েছেন।
সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম এক বছরের সশ্রম কারাদ- ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানায় দ-িত হয়েছেন। সাবেক সদস্য খুরশীদ আলম তিন মামলায় এক বছর করে তিন বছরের কারাদ- ও মোট ১৫ হাজার টাকা জরিমানার দ-ের আদেশ পেয়েছেন। তিনি মামলাটিতে একমাত্র আত্মসমর্পণ করা আসামি। তবে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার তিন মামলার সবকয়টি থেকে খালাস পেয়েছেন।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৩০ কাঠা প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে গত জানুয়ারিতে দুদক তিনটি পৃথক মামলা দায়ের করে। তিন মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিট জমা পড়ে ১০ মার্চ। পরে ৩১ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। মামলাগুলোতে মোট ৮০ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। দীর্ঘ শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষে বৃহস্পতিবার বহুল আলোচিত এই তিন মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারক।