ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে ফিরোজা খাতুনকে দেওয়া হয় ক্যামোথেরাপি। প্রস্তুতি নেওয়া হয় স্তন কেটে ফেলে দেওয়ার। একে একে চারটি ক্যামোথেরাপি দেওয়ার পর স্বজনদের পরামর্শে তিনি ভারত যান। সেখানে ডাক্তারের কাছে গেলে তারা তাকে নিয়ে গবেষণা করেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে জানানো হয় আপনার ক্যানসাার হয়নি। আপনি সুস্থ আছেন। এ সংবাদ পেয়ে কী করবেন ফিরোজা? দেশে যে ডাক্তাররা ক্যামো দিয়েছেন তাদের কথা বিশ্বাস করবেন, নাকি ভারতের ডাক্তারের কথা? ক্যানসার না হওয়া সত্ত্বেও তাকে যে ক্যামোথেরাপি দেওয়া হয়েছে এর কী হবে? তার শারীরিক কোনো ক্ষতি হবে না তো? নানা দুশ্চিন্তায় ফিরোজার ঘুম হারাম। এভাবেই কেটে গেছে তিনটি বছর। ফিরোজা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু তাতে কী? পেশায় একজন শিক্ষক ফিরোজার প্রশ্ন না জানি আমার মতো কত মানুষ ভুল পরীক্ষায় অকালে জীবন হারাচ্ছে। কিংবা অপারেশন করে অঙ্গ হারাচ্ছে। ভুল চিকিৎসার ফাঁদে যেন কেউ না পড়েন সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
২০১২ সালের মার্চ মাস। তার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সময়। দেশের নামিদামি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা হয়েছে, আপনার ডান পাশের স্তনে ক্যানসার ধরা পড়েছে। ‘কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। জীবিত ফিরোজা মৃত হয়ে গেলাম’। তিনি বলেন, স্লাইড পরীক্ষায় মেডিনোভা ও আনোয়ারা মেডিকেল সার্ভিসেস নামের দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেই ক্যানসার থাকার কথা বলেছিল। এরপর একটি নয়, দুটি নয়, চারটি ক্যামোথেরাপিও দেওয়া হয়। প্রস্তুতি চলে অপারেশনেরও। ডাক্তাররা বললেন, অপারেশন করে স্তন ফেলে দিতে হবে। কিন্তু অপারেশন করার আগে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন আত্মীয়স্বজনরা। স্বজনদের কথায় ভারতের কলকাতায় পাড়ি দেন তিনি। ওখানেও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান ডাক্তাররা। কিন্তু এসব পরীক্ষায় ক্যানসারের কোনো উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বলা হয়েছে ক্যানসার আছে, ভারতের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বলেছে ক্যানসার নেই। এরকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের চারপাশে। অধিকাংশ মানুষেরই এ দেশের চিকিৎসার ওপর আস্থা নেই। যারা সুযোগ পান তারা চলে যান বিদেশে। কিন্তু যারা বিদেশে যেতে পারেন না, তারা চিকিৎসার নামে প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হন বটে সুস্থ হন না। অনেকে অসুস্থ হলেও চিকিৎসা নিতে আগ্রহী নন।
‘আমার স্ত্রী বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। কষ্ট পাচ্ছে, তবুও সে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি না,’ বলছিলেন ঢাকার খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা ফখরুল আলম।
বছরখানেক আগে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে আলমের বড় ছেলে আহনাফ তাহমিদের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর শোকার্ত পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ‘আমার ছোট ছেলেরও খতনা করানোর সময় হয়েছে। কিন্তু তাকে যে হাসপাতালে নেবো, সেই সাহস পাচ্ছি না,’ বলেন তিনি।
সন্তানহারা এই বাবা এটাও জানিয়েছেন যে, তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন চিকিৎসক রয়েছেন। ফখরুল আলমের মতো বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, বিভিন্ন কারণে যারা দেশটির চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর সেভাবে ভরসা রাখতে পারছেন না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবা পেতে ভোগান্তি, রোগ ধরতে না পারা, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ভুল রিপোর্ট দেওয়া, রোগীকে যথেষ্ঠ সময় না দেওয়া, দায়িত্বে অবহেলায় মৃত্যু, স্বাস্থ্যসেবায় বাণিজ্যিক মনোভাব, জবাবদিহি ও নজরদারির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর থেকে সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। বেসরকারি হিসেবে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখের মতো মানুষ চিকিৎসা করাতে বিদেশে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, চিকিৎসার নামে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
‘দেশে অন্তত ১০-১২জন ডাক্তারকে দেখাইছি। কিন্তু কেউ বলতে পারেনি যে, আমার ঠিক কী হয়েছে,’ বলছিলেন বজলুর রহমান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বজলুর রহমানের বছর দুই আগে অনেকটা হঠাৎ করেই পেটে ব্যথা শুরু হয়। শুরুর দিকে কিছুটা কম থাকলেও ক্রমেই ব্যথার তীব্রতা বাড়তে থাকে। তখন তিনি সমস্যার সমাধানে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে যান। ‘তিনি আমাকে বেশকিছু টেস্ট দিলেন। সেগুলো করালাম, কিন্তু কিছুই ধরা পড়ল না। তখন ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে বলল, ওষুধগুলো খান, সব ঠিক হয়ে যাবে,’ নিজের ভোগান্তির কথা এভাবেই বলছিলেন এই ভুক্তভোগী। ওষুধগুলো খাওয়ার পর কিছুদিন ব্যথা ঠিকও হয়েছিল তার। কিন্তু মাস না পেরোতেই পুনরায় সেটি ফিরে আসে। এর পরের এক বছরে যে যেখানে রেফার করছে, সেখানে গিয়ে ডাক্তার দেখাইছি। কিন্তু কেউ বলতে পারে না যে, ঠিক কী রোগ হয়েছে, রোগ ধরা না পড়লেও ওই এক বছরে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং ওষুধ বাবদ এক লাখেরও বেশি টাকা খরচ করে ফেলেন বজলুর রহমান।
পরে পরিবারের সবার সঙ্গে আলোচনা করে রোগ নির্ণয়ে ভারতের চেন্নাইয়ে যান তিনি। ‘সেখানে গিয়ে দেখা গেল, আমার কোলনে আলসার। অথচ দেশের ডাক্তাররা এক বছরেও ধরতে পারল না। আমার টাকাও নষ্ট হলো, ভুগতেও হলো,’ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন তিনি।
সঠিকভাবে রোগ ধরা না পড়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতি বছর যত মানুষ বিদেশে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছেন, তাদের প্রায় ৫৩ শতাংশই রোগ নির্ণয় ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন বলে এক গবেষণায় জানা গেছে। বাংলাদেশে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগীদের পুরোনো একটি অভিযোগ হচ্ছে, ডাক্তাররা তাদের পর্যাপ্ত সময় দেন না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বে যেসব দেশে চিকিৎসকরা রোগীদের সবচেয়ে কম সময় দেন, বাংলাদেশ সেগুলোরই একটি।
দেশটিতে চিকিৎসকরা একজন রোগীর পেছনে গড়ে মাত্র ৪৮ সেকেন্ড সময় ব্যয় করে থাকেন।
সরকারি হিসেবে, দেশে বর্তমানে ১৫ হাজারের মতো নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যদিও বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসব হাসপাতালের একটি বড় অংশেই প্রশাসনের নজরদারি নেই। জেলা পর্যায়ের অনেক হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও নেই বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের অনেক বেসরকারি হাসপাতালে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলও নেই।
২০২৪ সালে ঢাকার সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় পাঁচ বছর বয়সি শিশু আয়ান আহমেদ।
ভুল চিকিৎসা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় আয়ানের মৃত্যু হয়েছে বলে তখন অভিযোগ তুলেছিল শিশুটি পরিবার।
ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর নির্মাণাধীন হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনুমোদন ছাড়াই হাসপাতালটি চলছিল বলে তখন জানান সরকারের কর্মকর্তারা।
মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয় হাই কোর্ট।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে শিশু আয়ানের মৃত্যুর জন্য ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সেখানকার দুই চিকিৎসককে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন কমিটির সদস্যরা।
সেই সঙ্গে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিহত শিশুর পরিবারকে দেওয়ার সুপারিশও করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ওইসব সুপারিশের কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হয়নি। সব অনিয়মের বিরুদ্ধে এরকমই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তদন্ত হয়, সুপারিশ দেওয়া হয়, কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে জবাবদিহির অভাবে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা এখন অরাজকতায় পূর্ণ হয়েছে।