জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম আলোচিত মুখ, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদি আর নেই। বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নইলাহি রাজিউন)। তার ভাই ওমর হাদি গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর বিজয়নগরে নির্বাচনী প্রচারণার সময় দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানলেন এই তরুণ লড়াকু নেতা।
যেভাবে রাজনীতির মঞ্চে হাদির উত্থান
ঝালকাঠির নলছিটির এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা শরীফ ওসমান হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। তবে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান তার জীবনকে আমূল বদলে দেয়। রাজপথের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং তেজস্বী বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দ্রুত জুলাই বিপ্লবের অগ্রনায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
ওসমান হাদির বাবা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় হাদির শিক্ষাজীবনের শুরু, পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সময় ইংরেজি শেখার কোচিং সেন্টার সাইফুরস এ শিক্ষকতা করেছেন হাদি। সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করছিলেন বলে ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীরা জানিয়েছেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তার হাত ধরেই গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। এই সংগঠনের ঘোষিত লক্ষ্য হলো—‘সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ’। আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি এবং জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে তিনি একটি বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হন।
আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দেখা যায়নি তাকে। ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যায় তাকে। ওসমান হাদি শুধু একজন নেতাই ছিলেন না, ছিলেন এক বিতর্কিত চরিত্রও।
ভারত-বিরোধী অবস্থান এবং বিএনপির নেতৃত্বের সরাসরি সমালোচনা করে তিনি যেমন বাহবা কুড়িয়েছেন, তেমনি অনেকের চক্ষুশূলও হয়েছেন। নির্বাচনি প্রচারণায় মুড়ি-বাতাসা বিতরণ, মসজিদের সামনে ভোররাতে লিফলেট বিলি কিংবা অনুদান সংগ্রহের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে তাকে নিয়মিত আলোচনার কেন্দ্রে রাখত।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুরে সক্রিয় অংশ নেন তিনি।
ইনকিলাব মঞ্চ গঠনের পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি রক্ষা, অপরাধীদের বিচার, আহত-নিহত ব্যক্তিদের স্বীকৃতি এবং জুলাই চার্টার ঘোষণার দাবি তুলে সভা সমাবেশ শুরু করেন হাদি। যা তাকে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
সমস্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ- ইনকিলাব মঞ্চের এই লক্ষ্য এবং এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তার দেওয়া আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী নানা বক্তব্য তাকে তৈরি করে দেয় একটি সমর্থক গোষ্ঠী।
অবশ্য এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন হাদি। সামজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে কিংবা সভা-সামবেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বেশ কয়েকবার ‘আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে’ বলেও দাবি করেন তিনি।
সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্টে তিনি দাবি করেছিলেন, দেশি–বিদেশি অন্তত ৩০টি ফোন নম্বর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তার বাড়িতে আগুন দেওয়া সহ মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
বারবার প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার কথা জানালেও দমে যাননি হাদি। আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়ে তিনি নতুন রাজনৈতিক শক্তির জানান দিচ্ছিলেন। তার মৃত্যুতে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
প্রসঙ্গত, গত ১২ ডিসেম্বর মতিঝিলে জুমার নামাজ পড়ে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করেন হাদি। এরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার পথে ওই দিন দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে হাদিকে বহনকারী অটোরিকশা পল্টন মডেল থানাধীন বক্স কালভার্ট এলাকায় পৌঁছালে মোটরসাইকেলে থাকা দুষ্কৃতকারীরা হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অপারেশন শেষে এভারকেয়ার পাঠানো হয়।
পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি আজ মারা যান।